সিলেটের কথা ::: সিলেটের ৭ পাথর কোয়ারির ব্যাপারে রুল জারি করেছেন উচ্চ আদালত। রবিবার (২৪ আগস্ট) বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি- বেলা দায়েরকৃত একটি জনস্বার্থমূলক মামলার (নং ১৩৪৮৫/২০২৫) প্রাথমিক শুনানী শেষে বিচারপতি কাজী জিনাত হক এবং বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দীকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ রুল প্রদান করেন।
আদেশে আদালত বলেন, সিলেট জেলার জাফলং, শাহ আরেফিন টিলা, ভোলাগঞ্জ, উৎমাছড়া, শ্রীপুর, বিছনাকান্দি এবং লোভাছড়া ও বান্দরবান জেলার ১০টি ঝিরি-ছড়া পাথর কোয়ারি থেকে ধ্বংসাত্মক, ক্ষতিকর ও বিপজ্জনকভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণ বন্ধে বিবাদীদের ব্যর্থতা ও নিস্ক্রিয়তা সংবিধান ও দেশে প্রচলিত আইন ও বিচারিক সিদ্ধান্তের লঙ্ঘন বিধায় কেন তা কর্তৃত্ববিহীন, অবৈধও জনস্বার্থ বিরোধী ঘোষণা করা হবে না এবং এ বিষয়ে অবহেলার কারণে কেন তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না?
জারিকৃত রুলে উল্লেখিত পাথর কোয়ারিগুলোকে কেন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা এবং পরিবেশবান্ধব টেকসই ইকো-ট্যুরিজম হিসেবে রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার নির্দেশ প্রদান করা হবে না তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। অননুমোদিত ও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের, পাথর উত্তোলনের ক্ষতিকর প্রভাব নিরূপণের এবং প্রকৃত দোষীদের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ কেন প্রদান করা হবে না- তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।
রুল জারির পাশাপাশি মহামান্য আদালত উল্লেখিত পাথর কোয়ারিগুলো থেকে ধ্বংসাত্মক, ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক পাথর উত্তোলন, সংগ্রহ ও অপসারণের কার্যক্রম যাতে আর না ঘটে সে বিষয়ে বিবাদীদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেছেন।
একইসাথে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, সিলেট ও বান্দরবন জেলার জেলা প্রশাসক কে পরিবেশবান্ধব টেকসই ইকো-ট্যুরিজম বিকাশের জন্য একটি মহাপরিকল্পনাএবং বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত পাথর কোয়ারি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা আগামী ৩ মাসের মধ্যে প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করেছেন আদালত।
মহামান্য আদালত সিলেট জেলার উল্লেখিত ৭টি পাথর কোয়ারিসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে ধ্বংসাত্মক, ক্ষতিকর ও বিপজ্জনকভাবে পাথর উত্তোলনের সাথে জড়িতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত ও প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে গৃহীতব্য ব্যবস্থাসম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রস্তুত ও আদালতে দাখিলের নির্দেশ প্রদান করেছেন খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক, সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে।
সর্বোপরি, মহামান্য আদালত সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে আদালতে স্বশরীরে হাজির হয়ে ২০২৪ সালের আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি সিলেটের পাথর কোয়ারিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণ বিষয়ে তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ৩ মাসের মধ্যে উপরোক্ত আদেশসমূহ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে হবে।
জানা যায়, ২০১৩ সালে সারাদেশের ৫১টি এলাকাকে সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ পাথর/বালুমিশ্রিত পাথর সমৃদ্ধ এলাকা ঘোষণা করে। পাথর কোয়ারিগুলোর অবস্থান সিলেট, সুনামগঞ্জ, লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও বান্দরবান জেলা। পাথর উত্তোলনের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় ২০২০ সালে দেশের সকল পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। পরবর্তীতে ২০২৫ সালে পাথর উত্তোলন বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করলে সিলেটের উল্লেখিত কোয়ারি ও কোয়ারি বহির্ভূত বিভিন্ন স্থান থেকে ধ্বংসাত্মকভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণ নির্বিচারে চলতে থাকে যা দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়।
এ অবস্থায় গত ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রণালয়েরউপদেষ্টার সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে, ইসিএভুক্ত সিলেট জেলার জাফলং, মামলাভুক্ত শাহ-আরেফিন টিলা ও বান্দবান পার্বত্য জেলার পাহাড়ি ঝিরি-ছড়া এলাকার ১০টিসহ মোট ১২ পাথর কোয়ারিতে পরিবেশগত বিধিনিষেধ থাকায় ইজারা কার্যক্রমের আওতা বহির্ভূত থাকবে, সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন ভোলাগঞ্জ, উৎমাছড়া; জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুর; গোয়াইনঘাট উপজেলাধীন বিছনাকান্দি এবং কানাইঘাট উপজেলাধীন লোভাছড়া পাথর কোয়ারিসমূহের ইজারা কার্যক্রম আপাতত স্থগিত থাকবে, অবশিষ্ট পাথর কোয়ারিসমূহ ইজারা প্রদানের পূর্বে পরিবেশের ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে, পাথর কোয়ারিসমূহ হতে অবৈধ/অননুমোদিতভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণের সাথে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরচিালনাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। কেবলমাত্র পাথর শ্রমিক ও পরিবহন ড্রাইভার নয়, অবৈধ/অননুমোদিতভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণের সাথে জড়িত এদের পৃষ্ঠপোষক/মূল হোতাদেরকে চিহ্নিত করে গ্রেফতারপূর্বক আইনের আওতায় আনতে হবে, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও অপসারণ কার্যক্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্ট স্থাপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসকল চেকপোস্ট/টাস্কফোর্স অভিযানের মাধ্যমে অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর পরিবহনকারী ট্রাক আটক করার উপর জোর দিতে হবে, পাথর কোয়ারিসমূহ থেকে অবৈধ/অননুমোদিতভাবে উত্তোলিত পাথর জব্দ করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, পাথর কোয়ারিসমূহ থেকে অবৈধ/অননুমোদিতভাবে পাথর উত্তোলন, আহারণ ও অপসারণের বিষয়ে জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্ট/টাস্কফোর্স অভিযান সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে প্রেরণ করতে হবে;, বিজ্ঞ আদালতের আদেশে বন্ধ থাকা পাথর কোয়ারিসমূহে যথাযথভাবে আদালতের আদেশ প্রতিপালন হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং সিলেটের পাথর কোয়ারি সংলগ্ন এলাকার পর্যটন শিল্পের বিকাশে জেলা প্রশাসন কর্তৃক একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আইন, আদালতের আদেশ ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধন্তের ব্যতয় ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণ অব্যাহত থাকলে তা বন্ধে বেলা উল্লেখিত মামলা দায়ের করে।
মামলার বিবাদীগণ হলেন- ভূমি মন্ত্রণালয়;বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রণালয় (জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদবিভাগ); পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (জন নিরাপত্তা বিভাগ); বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবংপানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব; পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকএবংসিলেটবিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক; খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক; সিলেট জেলার বিভাগীয় কমিশনার; সিলেট ও বান্দরবন জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার।
বেলা’র পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী। তাঁকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট এস. হাসানুল বান্নাএবং রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মুহা. এরশাদুল বারী খন্দকার।সূত্র:সিলেটভিউ
Leave a Reply