রেজওয়ান আহমদ ::: অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি হচ্ছে সিলেট, এই বিভাগের চারপাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট। যেমন- জাফলং, সাদা পাথর, রাতারগুল, বিছনাকান্দি, মাধবকুণ্ড, চা বাগান, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর সহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো দেখতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিদেশ থেকে সিলেটে ছুটে আসেন পর্যটকরা। পর্যটন নগরী হিসেবে সিলেটের নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে।
আমাদের দেশে নদ নদী ও হাওরের সংখ্যা বেশি, চারিদিকে নদ নদী আর হাওরের সৌন্দর্য ফুটে উঠে বর্ষা মৌসুমী। বর্ষা মৌসুমে সিলেটে পর্যটকের সংখ্যা থাকে বেশি, বাংলাদেশের মধ্যে দুটি বিশাল হাওর রয়েছে সিলেটে। একটি হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওর, আরেকটি হচ্ছে হাকালুকি হাওর। হাওরের সুন্দর্য্য দেখতে বর্ষা মৌসুমে পর্যটকরা ছুটে আসেন সিলেটে। কারণ বর্ষা মৌসুমী শুরু হলে হাওরের সৌন্দর্য্য অনেকটাই বেড়ে যায়।
আমরা সংবাদকর্মী যারা আছি, তারা ঈদে আনন্দ করতে আসা পর্যটকরা যখন পর্যটন স্পট ঘুরতে আসেন তখন আমরা সংবাদ সংগ্রহ করতে যাই। কিন্তু নিজেরা একসাথে দল বেঁধে আনন্দ করার সুযোগ পাইনা। বাংলাদেশ মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় কমিটি গঠনের পর থেকে একসাথে আনন্দ করার সুযোগ চলে আসে আমাদের মাঝে। ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে শুরু হয় ঈদ আনন্দ ভ্রমণের প্রস্তুতি। সবাই একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ঈদের পর টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার। সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে শুরু হয় আনন্দ, দেখতে দেখতে চলে আসে ঈদ। একদিকে ঈদের আনন্দ অন্যদিকে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের সুযোগ। ঈদের পরদিন থেকে শুরু হয় সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে আলোচনা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৪ জুন শনিবার সুনামগঞ্জ জেলার বিশাল হাওর টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার। আরিফ ও নরুল ভাইয়ের নেতৃত্বে শুরু হলো টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার প্রস্তুতি। সংগঠনের সকল সদস্যকে বলা হলো রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। সবার মাঝে শুরু হল আনন্দ, এক এক করে সবাই নাম অন্তর্ভুক্ত করলেন। সময় যত ঘনিয়ে আসছে তত সবার মাঝে ব্যস্ততা বাড়ছে।
ফয়সল আমিন, আরিফ, নুরুল, মুহিত ও ইমরান ভাইয়ের সাথে কিভাবে টাঙ্গুয়ার হাওরে আমরা যাব সেই বিষয় নিয়ে পরামর্শ হলো। সিনিয়রদের পরামর্শে সবাই কাজ শুরু করলাম। টি শার্ট, গাড়ি, নৌকা খাবার, ব্যানার এইসব ১৩ তারিখের মধ্যে প্রস্তুত করা হলো। এবার ১৪ জুন দুপুর ১২ টায় আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে উপস্থিত থাকার জন্য সকল সদস্যকে বলা হয়। ১৪ তারিখ সকাল ১১ টায় আমার মোবাইল ফোনে কল বেজে উঠে, মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখি বাবর ভাই কল দিয়েছেন। কল রিসিভ করার পর বাবর ভাই বলছেন- ভাই কোন জায়গায় আছেন? আমি বললাম- আম্বরখানায় সবুজের জন্য অপেক্ষা করছি, সে বলল তাড়াতাড়ি আসেন, আমি বললাম- ঠিক আছে আসছি। পরে সবুজ আসার পর তাকে নিয়ে জিন্দাবাজার অনন্যা নেটে গেলাম। সেখান থেকে আমরা কয়েকজন আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে যাই, গিয়ে দেখি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন চালক। তারপর এক এক করে সবাই আসলেন। সবাইকে দেওয়া হলো- টি-শার্ট। টি-শার্ট পরে সবাই ছবি তুললেন। আনন্দ ভ্রমণ উপলক্ষে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী, আনোয়ার ফাউন্ডেশন ইউকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি লিমন আহমদ। এসময় সংগঠনের সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান শেষে এক এক করে শাহ্ মো. কয়েস আহমদ, বেলায়েত হোসেন, ফয়সল আমীন, এ এইচ আরিফ, মো. নুরুল ইসলাম, শাহীন আহমদ, এম আর টুনু তালুকদার, রত্না আহমদ তামান্না, দেওয়ান আরাফাত চৌধুরী জাকি, তৌফিকুর রহমান হাবিব, রেজওয়ান আহমদ, মাছুম আহমদ চৌধুরী, জাবেদ এমরান, বাবর জোয়ারদার, রুবেল আহমদ, সবুজ আহমদ, মোশারফ হোসেন খাঁন, আকমল হোসেন সুমন, জাহিদ উদ্দিন, সুহেল আহমদ, ফুল মিয়া, মুজিবুর রহমান চৌধুরী চঞ্চল, রাধে মল্লিক তপন, মাজিদ চৌধুরী, মো. ঈসা তালুকদার, কৃতিশ তালুকদার, হারুনুর রশিদ, ফাহিদ আহমদ গাড়িতে উঠলেন। সবাই সিটে বসার পর গাড়ি ছাড়লেন চালক, শুরু হলো টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। গাড়ি চলছে আর সবাই আনন্দ করছে। গল্প আড্ডায় জমে উঠেছে ঈদ আনন্দ ভ্রমন, নগরী-শহর পেরিয়ে গাড়ি যখন নামাকাজি গিয়ে পৌঁছল তখন গাড়ি থামিয়ে টুনু ভাইয়ের পক্ষ থেকে সবাইকে গরমের মধ্যে ড্রিংস খাওয়ানো হয়। তারপর আবার গাড়ি চাললেন চালক, বিকেল চারটায় গাড়ি গিয়ে থামল সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভপুর উপজেলার পলাশপুর বাজারে, গাড়ি থেকে সবাই নামলেন, চা নাস্তা করলেন সবাই। যারা নামাজ পড়েন তারা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন এর পর আবার গাড়ি চাললেন চালক। সোহেল ও ইসা ভাইয়ের পক্ষ থেকে সবাইকে কালো জাম দেওয়া হয়, গাড়িতে বসে সবাই জাম খাচ্ছে আর আনন্দ করছে। গাড়ি চলতে চলতে সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছালাম তাহেরপুর বাজারে। গাড়ি থামালেন চালক, গাড়ি থেকে নেমে পরলেন সবাই। কিছু সময় হেঁটে নৌকা ঘাটে গিয়ে পৌছালাম আমরা। আগে থেকে ঘাটে নৌকা নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন মাঝি। এত সুন্দর নৌকা দেখে অনেকেই ছবি তুললেন, সবাই নৌকাতে উঠে বসলেন। মাঝি ছাড়লেন নৌকা, চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে, অন্ধকারের মধ্যে ছুটে চলেছে নৌকা। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি, নৌকায় জেনারেটার দিয়ে লাইট ও ফ্যান এর ব্যবস্থা রয়েছে। দেখতে খুব সুন্দর নৌকাটি পর্যটকদের জন্য সুন্দর করা হয়েছে নৌকা, নৌকার নাম দেওয়া হয়েছে জলসাঘর। নৌকা ঘাট থেকে নৌকা ছাড়লেন মাঝি। এক ঘন্টা উপরে নৌকা ভ্রমণের পর নীলাদ্রি টেকেরঘাট এলাকায় নৌকা ভিড়ালেন মাঝি। ঘড়ির কাঁটাই তখন রাত ৯ টা বাজে, মাঝি জানালেন রাতে এই ঘাটে থাকতে হবে। কারণ রাতের বেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকার ব্যবস্থা নেই। চারিদিকে শুধু পানি, ঝড় তুফান এলে দুর্ঘটনা হতে পারে। এর জন্য পর্যটকদের নিরাপত্তায় টেকেরঘাট এলাকায় সব পর্যটক বাহি নৌকা সারিবদ্ধ করে রাখা হয়। রাত দশটা থেকে শুরু হল খেলাধুলা, গান-বাজনা, একদল নৌকার ভিতর বসে খেলাধুলা করছে আরেক দল নৌকার উপরে গান বাজনা করছে। যারা কলম দিয়ে সংবাদ লিখে ও ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে তারা হয়ে গেলেন শিল্পী, গানের সুরে জমে উঠেছে ঈদ আনন্দ ভ্রমণ। একের পর এক গান হচ্ছে আর আশেপাশে পর্যটকদের মাঝে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছে, একদল গান করছে আরেক দল ভিডিও ও ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে, আনন্দের যেন শেষ নেই।
এর মধ্যে রাতের খাবার রান্না করেছেন বাবুর্চি, সুহেল ও কৃতিশ সবাইকে ডাক শুরু করলেন খাবার খাওয়ার জন্য, রাতের খাবার শেষ করে গল্প আড্ডা করতে করতে গভীর রাত হল, অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে আবার অনেকেই জেগে থেকে আড্ডা দিচ্ছে। একটু পরপরই আম ভর্তা, চানাচুর মুড়ি, বাদাম, চা-নাস্তা খাওয়া হচ্ছে। পলাশপুর বাজার থেকে সবুজ বাদম কিনলেও গাড়িতে কাউকে না দিয়ে তার কাছে রেখে দেয়। রাত দুইটায় বেশীরভাগই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন সে বাদম বের করে নিজে খাওয়া শুরু করে, এরপর কয়েকজন এসে হাজির হলে তাদের মধ্যে বিতরণ করে। দেখতে দেখতে ভোর হল। সকালের নাস্তা রেডি করলেন বাবুর্চি। ঘুম থেকে উঠলেন অনেকেই। যারা সজাগ ছিলেন তারা একসাথে বসে মুড়ি-বিস্কুট দিয়ে চা খেলেন। কিন্তু আমি সকাল বেলায় চা না খেয়ে খিচুড়ি খাই। এরপর একসাথে সবাই বসে নাস্তা করলেন। নাস্তা শেষ করে নীলাদ্রি লেকে ঘোরাঘুরি করে ছবি তুললেন সবাই মিলে।
তারপর সকাল ৮ টায় টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশ্যে নৌকা ছাড়লেন মাঝি, সকাল দশটায় গিয়ে পৌছালাম টাঙ্গুয়ার হাওরে। এই প্রথম আমরা টাঙ্গুয়ার হাওরে গেলাম তাই আনন্দও বেশি, মাঝি নৌকা দিয়ে ঘুরে ঘুরে টাঙ্গুয়ার হাওর দেখালেন সবাইকে। চারিদিকে পানি আর পানি, হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মন জুড়িয়ে গেল সবার। তারপর মাঝি নৌকা নিয়ে ওয়াচ টাওয়ারের নিচে গেলেন সেখানে ছোট ছোট নৌকা রয়েছে। হাওরের মাঝে রয়েছে শত শত গাছ, দেখতে অপরূপ সুন্দর। সেই গাছের দৃশ্য দেখার জন্য এই ছোট্ট নৌকা দিয়ে যেতে হয়। ৭-৮ জন দল করে নৌকা নিয়ে বের হলাম, এক ঘন্টা ঘুরাঘুরি করে ওয়াচ টাওয়ারের নিচে গেলাম। এই টাওয়ারের উপর থেকে হাওরের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায় খুব সুন্দর। এরপর শুরু হলো হাওরের পানিতে গোসল করার প্রতিযোগিতা, লাইফ জ্যাকেট পরে সবাই গোসল করতে নেমে পরলাম, শুরু হলো পানির মধ্যে দুরন্তপনা। ১ ঘন্টা হাওরের পানিতে সবাই মিলে আনন্দ করে নৌকার মধ্যে উঠে পড়লাম। তখন সময় দুপুর বারোটা বাজে। শুরু হলো মেঘ, নৌকা ছাড়লেন মাঝি। নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে আর সবাই মিলে আনন্দ করছে। আনন্দ ভ্রমণে সিনিয়র জুনিয়রদের মধ্যে মিলন-মেলায় পরিণত হয়। হাওরের মাঝে নৌকা দাঁড় করিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য বসে পড়লেন সবাই। খাবার শেষে নৌকা চাললেন মাঝি, বিকেল তিনটায় তাহিরপুর নৌকা ঘাটে এসে পৌঁছলাম আমরা।
নৌকা থেকে হাসিমুখে নামলেন সবাই, কিছু সময় হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসার পর সিলেটের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়লেন চালক। সড়কের দুইপাশের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে দিরাই রাস্তার সামনে এসে গাড়ি থামালেন চালক। চা-নাস্তা করে আবার গাড়িতে উঠলেন সবাই, আবার গাড়ি ছাড়লেন চালক, সন্ধ্যায় এসে পৌঁছলাম তেমুখী পয়েন্টে। চালক এসে বললেন গাড়িতে গ্যাস শেষ হয়ে গেছে, সামনে আর যাওয়া যাবে না। পাম্পের মধ্যে দীর্ঘ লাইন, দেরি হবে গ্যাস নিতে। তাই আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম, উদ্দেশ্য এখন নিজ নিজ বাসায় যাওয়ার। সবার সাথে কৌশল বিনিময় করে নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটে চললাম আমরা এর মধ্যে দিয়েই শেষ হলো বাংলাদেশ মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় কমিটির টাঙ্গুয়ার হাওরে দুই দিনের ঈদ আনন্দ ভ্রমণ।
Leave a Reply