সিলেটের কথা :: দেশে ফের চোখ রাঙাতে শুরু করেছে মহামারি করোনাভাইরাস। গত কয়েক দিনে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে জারি করা হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। বিদেশ ফেরতদের মাধ্যমে এই ভ্যারিয়েন্টগুলো দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতসহ আশপাশের কয়েকটি দেশে সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য অধিদফতর ইতিমধ্যে সতর্কতা জারি করেছে। প্রয়োজন ছাড়া এসব দেশে ভ্রমণ না করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে যেসব বিদেশি যাত্রী বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন, তাদেরও স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে বিদেশ ফেরত অনেক যাত্রী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, ঝুঁকি কমাতে কর্তৃপক্ষের আরও সক্রিয় ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
করোনা প্রতিরোধ-সংক্রান্ত তৎপরতা প্রায় নেই বললে চলে। স্বাস্থ্য অধিদফতরে করোনার তথ্য সংগ্রহ-সংক্রান্ত কাজও ঢিমেতালে চলছে। এ পরিস্থিতিতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। ভারতেও নতুন একটি ধরনের সংক্রমণ বাড়ছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার দেশে করোনায় একজনের মৃত্যু হয়। আশঙ্কাজনক না হলেও দেশে এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে।
মঙ্গলবার (১০ জুন) স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে নতুন আরও ১৩ জনের করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। শনাক্ত রোগীদের সবাই ঢাকার বাসিন্দা। এই সময়ে কারও মৃত্যু হয়নি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। মে মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ জনে। আর জুন মাসের প্রথম ১০ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ৫৮ জন এবং একজন মৃত্যুবরণ করেছেন।
এ পরিস্থিতিতে করোনার সম্ভাব্য বিস্তার বন্ধে এর পরীক্ষার সরঞ্জাম সংখ্যা বাড়ানো এবং আবার টিকা দেওয়া শুরুর কথা বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বয়স্ক, ভিন্ন কোনো জটিল রোগে ভুগছেন বা গর্ভবতী নারী তাদের জন্য তো বটেই, এমনকি যেসব ব্যক্তির সবশেষ টিকা নেওয়ার মেয়াদ ছয় মাস পার হয়ে গেছে, তাদেরও করোনার টিকা নেওয়া উচিত।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সূত্রে জানা গেছে, দেশে এখন ৩১ লাখ টিকা মজুদ আছে। এর মধ্যে ১৭ লাখের মেয়াদ আগামী আগস্ট মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। করোনার টিকা আবার নতুন করে শুরু করার বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারণী স্তরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) গবেষকরা করোনার নতুন একটি ধরন শনাক্তের কথা বলছেন। এর নাম এক্সএফজি। পাশাপাশি এক্সএফসি ধরনটিও পাওয়া গেছে। দুটোই করোনার শক্তিশালী ধরন অমিক্রনের জেএন-১ ভ্যারিয়েন্টের উপধরন।
আইসিডিডিআরবির হেড অব ভাইরোলজি ল্যাবরেটরি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন এ ধরন নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ভাইরাসের ধরন পরিবর্তন হয় দ্রুত। তবে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। বাংলাদেশে নতুন ধরনের পাশাপাশি ভারতেও এনবি.১.৮.১ নামে একটি নতুন ধরনের বিস্তার দেখা যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গত ২৩ মে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, এনবি.১.৮.১ ধরন এখন ক্রমেই ছড়াচ্ছে। এর সংক্রমণের হারও বেশি। তবে করোনার আগের ধরনগুলোর চেয়ে এই ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি নয়। ভারতে ছড়িয়ে পড়া এই ধরন বাংলাদেশে যে আসবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং ঝুঁকি আছে যথেষ্ট, এমনটাই মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ দেখা দিয়েছে দক্ষিণ ভারতের কেরালায়। তারপরে গুজরাট এবং পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান। এই স্থানগুলোকে ‘সংক্রমণের হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আশঙ্কা করছে, এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট ভারতের সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশেও প্রবেশ করতে পারে। এ জন্য বেনাপোলসহ সব স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মানার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জোরদার করা হয়েছে। সন্দেহভাজন যাত্রীদের জিনগত পরীক্ষা এবং নজরদারি বাড়ানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারতসহ যেসব দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়েছে, ওইসব দেশে ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রয়োজন ছাড়া ওইসব দেশে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরিচালক ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, সাধারণত গরম গুমোট আবহাওয়ায় করোনাভাইরাস বেশি সংক্রমিত হয়। অন্যান্য বছরও মে মাস থেকেই করোনার প্রকোপ বেড়েছে, এ বছরও তাই হয়েছে।
এদিকে ঈদের ছুটির পরে ফিরতি যাত্রায় সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এক সরকারি চিঠিতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে।
রোববার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি কোভিড-১৯ সংক্রমণ হারের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনা করে জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় সবাইকে মাস্ক পরার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিশেষত বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভিড়যুক্ত স্থান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, শুধু ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী নয়, আসলে যাদের করোনার টিকা নেওয়ার মেয়াদ ছয় মাস পার হয়ে গেছে, তাদেরও টিকা নিতে হবে। আর সেই উদ্যোগ যদি নিতে হয় তবে এখন যে টিকা আছে, তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। সরকার ইচ্ছে করলে এ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা অন্য দাতাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। যারা বয়স্ক, কিডনি রোগী, গর্ভবতী নারী, ক্যানসার রোগী, হাঁপানিতে ভোগেন বা অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় আক্রান্ত তাদের জন্য এই ভাইরাস ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ডা. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, কোভিডের যেকোনো ভ্যারিয়েন্টই বয়স্ক, গর্ভবতী ও আগে থেকে জটিল রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে আবারও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এখন থেকেই নিয়মিত হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার, মাস্ক পরা ও ভিড় এড়িয়ে চলা এই অভ্যাসগুলো আবার শুরু করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতে যাবেন বা যারা চিকিৎসা দেবেন তাদের সবাইকে মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
Leave a Reply