আন্তর্জাতিক ডেস্ক ::: ‘ম্যাড ম্যাক্স বিয়ন্ড থান্ডারডোম’, ‘প্রিসিলা’, ‘ডেজার্ট কুইন’ ও ‘রেড প্ল্যানেট’ চলচ্চিত্র যারা দেখেছেন, বিস্তারিত না জানলেও তারা এ শহর এবং তার পরিবেশের সঙ্গে অনেকটাই পরিচিত। কারণ এই চলচ্চিত্রগুলো প্রায় ১১০ বছর বয়সী এক শহরে চিত্রায়িত হয়েছিল।
১৯১৫ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমি অঞ্চলে, অ্যাডিলেড শহর থেকে প্রায় ৮৫৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয় দামি রত্ন ‘ওপালের খনি’। সেসব খনি থেকে ওপাল তুলে ব্যবসা করতে আসা ইউরোপীয় সাদা মানুষেরা ধীরে ধীরে এই খনি এলাকাতেই গড়ে তোলে শহর।
তবে প্রথাগতভাবে মাটির ওপরে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে পারেনি তারা। তাই ভাবতে হয়েছিল বিকল্প।
কারণ মরুময় সেই অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে আবহাওয়া ভয়ংকর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সে সময় সেখানকার তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। আর শীতকালে রাতের তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি। কিন্তু মাটির নিচে তাপমাত্রা থাকে সহনীয়। সেখানে গড় তাপমাত্রা ২০-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরম ও শীতে মাটির নিচে প্রায় একই রকম তাপমাত্রা থাকে বলে সেটা আরামদায়ক।
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এই অঞ্চলে খনি থেকে রত্নপাথর তুলে অর্থ উপার্জনে আসা ইউরোপীয় সাদা মানুষেরা ওপাল পাওয়ার জন্য খনন করত। প্রচণ্ড গরম আর ধুলোঝড় থেকে বাঁচতে তারা সেই খনিগুলোতেই বসবাস করত। স্থানীয় কোকাথা বা আরবানা গোষ্ঠীর আদিবাসীরা সাদা মানুষদের এই খোঁড়াখুঁড়ি দেখে এলাকাটির নাম দেয় কুপা পিটি বা কুবেরা পিটি। এর অর্থ সাদা মানুষের গর্ত বা গর্তে বসবাসকারী মানুষ।
অবশ্য অনেকে মনে করেন, নামটি এসেছিল আদিবাসী কুবি-পেডি শব্দ থেকে। এর ইংরেজি অর্থ গুড ওয়াটার হোল। বাংলায় বলা যেতে পারে, শুষ্ক এলাকায় খুঁজে পাওয়া পানির উৎস। আদিবাসীরা এই মরুময় শুষ্ক এলাকায় পানির উৎস খুঁজে পেয়েছিল।
১৯২০ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই শহরের নাম ‘কুবার পেডি’ হিসেবে নথিভুক্ত করে।
পুরো শহরই মাটির নিচে
বৈরী প্রকৃতি থেকে বাঁচার কোনো পথ না থাকায় গির্জা, দোকানপাট, বার, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি সবই মাটির নিচে ছিল। মাটির নিচের এই ঘরগুলোকে বলা হয় ডাগআউট। কিছু কিছু ডাগআউট আবার বিলাসবহুল। সেখানে আছে সুইমিংপুল, গেম রুম, আলিশান বাথরুম! ২০২৩ সালের গণনা অনুসারে এসব ডাগআউটে এখন স্থায়ীভাবে বসবাস প্রায় ১ হাজার ৮০০ জন মানুষ। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, নতুন ঘর তৈরি করতে গিয়ে যে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়, তাতে মাঝেমধ্যে পাওয়া যায় দামি ওপাল পাথর। সেগুলোর বাজারমূল্য কয়েক লাখ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
খরচ কম তবে আরাম বেশি
কুবার পেডির বাসিন্দারা সৌর ও বায়ুশক্তিনির্ভর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। যদি কেউ মাটির ওপর বসবাস করতে চায়, তাদের প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যয় করতে হয় প্রচুর অর্থ। অন্যদিকে মাটির নিচে বসবাসে সেসব খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। তা ছাড়া শহরটিতে বাড়ির দামও তুলনামূলকভাবে কম। তিন কক্ষের শোবার ঘরসহ মাটির নিচের বাড়ি পাওয়া যায় মাত্র ৪০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলারে। যেখানে অ্যাডিলেড শহরে একই আকারের বাড়ির দাম প্রায় ৭ লাখ ডলার।
আরও পড়ুন
কখনো মাটি স্পর্শ করে না যে মানুষেরা
পর্যটন আকর্ষণ
বলে রাখা ভালো, এই কুবার পেডি থেকে বিশ্বের ৯০ শতাংশ মূল্যবান ওপাল উত্তোলন করা হয়। পর্যটকেরা এখানে খনি সফর করতে এবং নিজেরা পাথর খুঁজতে পারেন। পর্যটকদের ওপাল খোঁজার এই প্রক্রিয়ার নাম নুডলিং। এখানে ওপাল খনির ইতিহাস জানানোর জন্য আছে ওল্ড টাইম মাইন ও মিউজিয়াম। আছে ফেয়ামুস গ্রাসহাউস চার্চ নামের ভূগর্ভস্থ গির্জা আর ডেজার্ট ক্যাথেড্রাল। মুন প্লেইন নামে দেখতে চাঁদের পৃষ্ঠের মতো একটি ল্যান্ডস্কেপ আছে।
তবে যারা গলফ বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন, এখানে আছে তাদের জন্য দারুণ এক গলফ কোর্স। নাম তার কুবার পেডি গলফ ক্লাব। সম্ভবত এটি পৃথিবীর একমাত্র ধূলিঝড়প্রবণ মরুভূমির কোর্স, যেখানে সবুজ ঘাসের বদলে আছে বালু ও ধূসর মাটি।
পৃথিবীর অন্য প্রান্তেও এমন শহর
কুবার পেডি প্রথম বা একমাত্র আন্ডারগ্রাউন্ড শহর নয়; প্রাচীন তুরস্কের কাপাদোকিয়া অঞ্চলেও রয়েছে ডেরিনকুয়ু নামের এক বিস্ময়কর ভূগর্ভস্থ শহর। সেখানে একসময় ২০ হাজার মানুষ একসঙ্গে বসবাস করত। সে ভূগর্ভস্থ শহরে বাতাস চলাচলের জন্য রয়েছে পাইপ, পানির কূপ, গির্জা, গুদামঘর। তবে মাটির নিচে বসবাসের বড় বাধা হলো আর্দ্রতা। বৃষ্টি বেশি হলে কিংবা জায়গাটি পানির স্তরের কাছাকাছি হলে দেয়ালে স্যাঁতসেঁতে ভাব হয়। এ থেকে দেখা দিতে পারে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ কারণে মাটির নিচের শহরগুলো সাধারণত শুষ্ক, উষ্ণ এলাকায় গড়ে ওঠে।
ভবিষ্যত বাসস্থান
বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বাড়ার ফলে আমেরিকা, ইউরোপ, চীনসহ অনেক দেশে অসহনীয় গরম দেখা যাচ্ছে। চীনের চোংকিং শহরে সম্প্রতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি বাংকারগুলো খুলে দেওয়া হয় দাবদাহ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে। এই বাস্তবতায় কুবার পেডি যেন ভবিষ্যৎ শহরের এক দারুণ উদাহরণ।
Leave a Reply